কলা গাছের তন্তু হতে সুতা ও হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরির মাধ্যমে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন তথা জেলার সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন
“বারো জাতির ঐকতান, সম্প্রীতির বান্দরবান”- বৈচিত্র্যের এ শ্লোগান নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি সম্প্রদায় সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থান করছে। তবে পেশার বৈচিত্র্যের অভাবে এ জেলার অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় শুধু জুমচাষের উপর নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ফলত: মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদিসহ এ জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে পিছিয়ে, যা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১)-এর অন্যতম লক্ষ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ বাস্তবায়ন এবং এসডিজি-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
আমি জেলাপ্রশাসক হিসেবে যোগদানের অব্যবহিত পরই পরবর্তী তিন বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতকালে বান্দরবানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, কৃষি ও পর্যটন বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটনকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের স্যুভেনির, শোপিস, সৌখিন পণ্য তৈরি করে তাদের দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসার করে থাকে। শুধু তাই নয়, উৎপাদিত এসকল পণ্য বিপণন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মাধ্যমে তারা তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। এ প্রেক্ষিতে অপরূপা বান্দরবানের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরে পর্যটনসম্পৃক্ত স্যুভেনির তৈরির প্রচেষ্টা গ্রহণকালে এ এলাকায় কলাগাছের প্রাচুর্য্য এবং কলাগাছ ব্যবহারের বহুমুখী সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হওয়ায় কলাগাছের তন্তু থেকে সুতা প্রস্তুত করার বিষয়টি আমার নজরে আসে। এ কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করে নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করা যায় কি-না বিষয়টি নিয়ে আমি মনোযোগ প্রদান করি।
বান্দরবানের আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তার দুপাশে অসংখ্য কলাগাছ চোখে পড়ে। কলাগাছ একটি এক ফসলি উদ্ভিদ; কলা সংগ্রহের পর ফেলে দেওয়া গাছ হিসেবে এটির কোন বিশেষ অর্থনৈতিক উপযোগ থাকে না। তাই কলাগাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রচলন করে এবং কলাগাছের তন্তু হতে সুতা ও সুতাজাত হস্তশিল্পের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জেলার সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিবেচনায় আমার সহকর্মী এবং অন্যান্য সরকারি/বেসরকারি দপ্তরকে অন্তর্ভুক্ত করে আমি পরীক্ষামূলকভাবে “কলা গাছের তন্তু হতে সুতা ও হস্তজাত পণ্য তৈরির” পাইলট প্রকল্পটি গ্রহণ করি এবং এ লক্ষ্যে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করি।
শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যের পর্যাপ্ত বিকাশ না হওয়ায় পার্বত্য জেলা বান্দরবানে দারিদ্র্যের হার অত্যধিক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা হিসেবে বান্দরবানের অবস্থান দ্বিতীয়। জেলাপ্রশাসক হিসেবে আমার এ উদ্যোগের ফলে প্রকল্পের উপকারভোগীগণ সুতা তৈরি, পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে একদিকে যেমন দারিদ্র্য হতে মুক্ত হতে সক্ষম হবে, তেমনি অন্যদিকে তাদের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি ঘটবে। এ প্রকল্পের সুবিধা হল প্রান্তিক নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী তাদের বাড়িতে বসেই সুবিধাজনক সময়ে পণ্য তৈরিতে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন; ফলে শোভন জীবিকাপ্রাপ্তির সাথে সাথে স্বাবলম্বী হয়ে নিজ পরিবারের অর্থনৈতিক তথা সার্বিক উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন। ফলত: এ উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়নের সাথে সাথে জেলার দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হার হ্রাসসহ দেশের অন্যান্য জেলার সাথে তুলনামূলক আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে। শুধু তাই নয়, গৃহীত এ উদ্যোগ বান্দরবানের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্ন্তভুক্তিমূলক উন্নয়নেও অবদান রাখবে।
“কলা গাছের তন্তু হতে সুতা ও হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরি” প্রকল্পটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্ভাবনী উদ্যোগ (উদ্যোগ-৫, ৮, ৯, ১০), জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ এর লক্ষ্যমাত্রা (লক্ষ্য-১, ২, ৫, ৮, ৯, ১০, ১৩, 15, ১৭) এবং ভিশন-২০৪১ অর্জনে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে মর্মে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস